ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত ধনী ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে গরীব ব্যক্তিদের দিতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ সমাজের বিত্তশীল ব্যক্তিবর্গ তাদের যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে যাকাতের হিসাব বের করে গরীব অসহায় ব্যক্তিদের প্রদান করবেন। এতে করে সমাজে মানবিক বৈশম্য দূর হয়ে থাকে।

যাকাত সকলের জন্য ফরজ নই। যাকাত ফরজ হওয়া, কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত আদায় করতে হয়, কোন কোন খাতে যাকাতের অর্থ দিতে হয় এবং কাদেরকে যাকাত দিতে পারবেন না সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।

যাকাতযোগ্য সম্পদ যাকাতের হিসাব

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ৫টি শর্ত আছে। শর্তগুলো হচ্ছে:-

১। নিসাব পরিমান সম্পদ।

২। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী ১ বছর অতিক্রম করা।

৩। নিজের সম্পদ হওয়া।

৪। সম্পদগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া।

৫। রূণগ্রস্থ না হওয়া।

১। নিসাব পরিমান সম্পদ

শরীয়তে একটি নির্দিষ্ট পরিমান সম্পদকে নিসাব পরিমান সম্পদ বলা হয়। শরীয়তে ২ টি জিনিষ দ্বারা নিসাব পরিমাপ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে রোপ্পো বা রুপা অপরটি হচ্ছে স্বর্ন।

এই ক্ষেত্রে স্বর্নের পরিমান হচ্ছে ৭.৫ (সাড়ে সাত) তোলা বা ভরি। আর রুপার ক্ষেত্রে ৫২.৫ (সাড়ে বায়ান্নো) তোলা বা ভরি। তোলা আর ভরি এই দুইটি একই জিনিষ।

আন্তর্জাতিকভাবে বল্লে স্বর্নের ক্ষেত্রে ৮৫ গ্রাম স্বর্ন। আর রুপার ক্ষেত্রের ৫৯৫ গ্রাম রুপা।

উপরুক্ত হিসাব পরিমান স্বর্ন বা রুপা বা এই পরিমান অর্থ থাকলে আপনি যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক বলে গন্য হবেন। অর্থাৎ আপনার উপর যাকাত ফরজ।

এখন এখানে একটি বিষয় তা হচ্ছে, স্বর্ন বা রুপার দাম অনেক কম বেশি। সেই ক্ষেত্রে আমরা কোনটি ধরবো। এখানে অনেকের অনেক রকম মত রয়েছে। অনেকে স্বর্নকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে থাকেন। তার কারন হচ্ছে স্বর্নের দাম অনেকটাই স্ট্যাবল।

তবে অনেকে রুপার দামকেউ নিসাব ধরার পক্ষে। এতে করে অনেকের উপর যাকাত ফরজ হয়ে থাকে। যার ফলে বেশি পরিমানে লোক উপকৃত হতে পারে।

এখন আপনি উপরের যেকোনটি নেসাব ধরে যাকাত আদায় করতে পারেন।

আরো পড়ুন: দানে কমে না বরং বাড়ে

২। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী ১ বছর অতিক্রম করা

ধরে নিলাম, আপনি রুপার দামকেই নিসাব পরিমান ধরলেন। তাহলে বর্তমান বাজার অনুযায়ী আনুমানিক ৫২.৫ ভরি রুপার দাম কম-বেশি ৫০০০০/= (পঞ্চাশ হাজার) টাকা। এখন এই পরিমান টাকার মালিক যেই দিন হবেন, সেই দিনের চাঁদের তারিখ থেকে পরবর্তী চাঁদের বছরের উক্ত তারিখ পর্যন্ত সেই পরিমান টাকা আপনার মালিক বহাল থাকা আবশ্যক।

মনে করলাম আপনি, রমজান মাসের ১০ তারিখে ৫০০০০/= টাকার মালিক হলেন। তাহলে চলতি রমজান মাসের তারিখ থেকে পরবর্তী বছরের রমজানে মাসে দেখতে হবে আপনার কাছে ৫০০০০/= টাকার পরিমান সম্পদ বা টাকা আছে কি না। যদি থাকে তবে সেই টাকা বা সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে।

এখন এখানে আরেকিট বিষয় পরিস্কার না করলেই নই। মনে করেন আপনার কাছে রমজানের ১০ তারিখ ৫০০০০/= টাকার মালিক হলেন। বছর ঘুরে আসার মাঝখানে ৫০০০০/= টাকার অনেক কম টাকা হয়ে গেল কিন্তু রমজানের ১০ তালিখের আগেই বা ১০ তারিখেই আবার ৫০০০০/= টাকার মালিক হয়ে গেলেন। তাহলেও ধরা হবে আপনার কাছে এই পরিমান সম্পদ বা টাকার স্ট্যাবিলিটি আছে। তাই সেই টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। এইখানে মাঝের সময়ে আপনার অবস্থা বিবেচ্য নই। তবে যদি উক্ত তারিখে অর্থাৎ এক বছর অতিক্রম করে ঠিক নির্ধারিত তারিখ বা রমজানের ১০ তারিখে আপনার কাছে ৫০০০০/= টাকা বা সেই পরিমান সম্পদ না থাকে তবে তার যাকাত আদায় করতে হবে না।

এরপর যখন আপনি আবার কোন দিন যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হবেন। আবার সেই তারিখ লিখে রাখবেন। কারণ পূর্বের তারিখ এখানে আর প্রোযোজ্য নই।

তবে হ্যাঁ, আপনার যদি মনে না থাকে আপনি কবে নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হয়েছেন, তবে আপনি আপনার মত যথাপযুক্ত সময়কে নির্ধারন করে নিতে পারেন।

৩। নিজের সম্পদ হওয়া

বিষয়টি বিস্তারিত বলার কিছু আছে বলে মনে করি না। কারন আপনি আপনার নিজ সম্পদের যাকাত আদায় করবেন। কারো সম্পদকে যেমন আপনি নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। তেমনই পরের সম্পদ আপনার কাছে আমানত বা যেকোন ভাব থাকলেও তার উপর আপনার যাকাত ফরজ নই।

একমাত্র সেই সম্পদের উপর আপনার উপর যাকাত ফরজ। যেই সম্পদের মালিক আপনি নিজেই।

৪। সম্পদগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া

যাকাত সেই সব সম্পদের উপর যেই সম্পদ বা টাকা গুলো আপনার কাজে আসে না। অর্থাৎ উদবৃত্ত টাকা বা সম্পদ। যেই টাকা ছাড়াই দিব্বি আপনার সংসারের খরচ হয়ে যাচ্ছে। যেই সব জিনিষ গুলো আপনি নিজে ব্যবহার করেন, যেমন- আপনার একটা মটরসাইকেল আছে বা ল্যাপটপ আছে এমন সব জিনিষ যাকাতের মধ্যে গন্য নই। তবে স্বর্নের ক্ষেত্রে ভিন্ন। আপনি যেই স্বর্ন ব্যবহার করেন তা যাকাত যোগ্য সম্পদ বলে বিবেচ্য।

৫। রূণগ্রস্থ না হওয়া

রূণগ্রস্থ না হওয়া। অর্থাৎ আপনি এতটাই রূণী যে, আপনার যাকাত যোগ্য সম্পদের চাইতে বেশি রূণগ্রস্থ। তাহলে আপনার উপর যাকাত ফরজ হবে না। রূণের কিছু ক্যটাগরী রয়েছে। একটি রূণ হচ্ছে একবারে পরিশোধ যোগ্য অপরটি হচ্ছে কিস্তি ভিত্তিক পরিশোধ যোগ্য।

একবারে পরিশোধ যোগ্য রূণ হলে সেই রূণ পরিশোধ করার পরে যদি আপনার কাছে যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদ অবশিষ্ট্য না থাকে। তবে আপনার উপর যাকাত ফরজ নই। আর রূণ পরিশোধ করার পরেও যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদ বা টাকা থাকে তবে যাকাত আদায় করতে হবে।

আর কিস্তি ভিত্তিক রূণ হলে সর্বচ্চ এক বছরে যেই পরিমান অর্থ কিস্তির মাধ্যমে রূণ পরিশোধ করতে হবে তা বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে।

আবার এমন হতে পারে আপনি কারো কাছে টাকা পান। আর সেই টাকা যদি ফিরে পাবার শতভাগ নিশ্চয়তা থাকে; তবে যাকাতের টাকা হিসাব করার সময় সেই টাকারও যাকাত বের করতে হবে। আর যদি পাওনা টাকা ফিরে পাবার নিশ্চয়তা না থাকে তবে সেই টাকার যাকাত দিতে হবে না।

যাকাতের হিসাব কিভাবে বের করবেন?

যেই দিন আপনার যাকাতের নিসাব এক বছর অতিক্রম করবে, সেই দিন আপনি আপনার যাকাতের হিসাব বের করবেন। উক্ত দিন আপনাকে দেখতে হবে, আপনার ক্যাশ টাকা কত আছে, ব্যাংকে কত আছে। যদি স্টক মার্কেটে ইনভেষ্ট করা থাকেন তবে সেই দিনের দাম অনুযায়ী কত টাকার শেয়ার আপনার রয়েছে। এই ছাড়া বেশ কিছু এমন সম্পদ আছে যা সহজেই ক্যাশ করা যায়, যেমন- প্রাইজ বন্ড, সঞ্চয় পত্র, ফিক্স ডিপোজিট, ডিপিএস, ইন্সুরেন্স (হেলেথ ইন্সুরেন্স, লাইফ ইন্সুরেন্স) ইত্যাদি।

এইগুলো হিসাব করার ক্ষেত্রে আপনি ব্যাংক বা বীমা কম্পানি থেকে একটা স্টেটমেন্ট নিয়ে নিবেন যে, আজকের দিনে আপনার ফিক্স ডিপোজিটটি বা ইন্সুরেন্স ভাঙ্গালে কত টাকা পাবেন, তার একটা স্টেটমেন্ট নিয়ে যাকাতের হিসাব বের করবেন।

ব্যবসার সম্পদে যাকাত দিতে হবে। আপনি যেই সব সম্পদ বিক্রয়ের নিয়তে বা বিক্রয় করবেন ভেবেই কিনে রেখেছেন সেই সম্পদের যাকাত দিতে হবে। যেমন ধরুন আপনি একটি গাড়ী কিনেছেন এই ভেবে যে, এই গাড়ী ভাল ক্রেতা, ভাল দাম দেখে বিক্রয় করবেন। তাহলে যেই দিন যাকাতের হিসাব করবেন সেই দিন গাড়ীটি বিক্রয় করলে কেমন দাম পেতে পারেন তার উপর হিসাব করে যাকাত বের করবেন। এই ভাবে আপনি কোন জায়গা ক্রয় করেছেন বিক্রয় করার নিয়তে বা বাড়ী কিনেছেন বিক্রয় বা ভাড়া খাটানোর নিয়তে তবে সেই সম্পদেরও যাকাত আদায় করতে হবে।

তবে বিক্রয় করার ইচ্ছায় ক্রয় না করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে না। তবে এমন হতে পারে যে, ধরুন যখন আপনি কোন জমি ক্রয় করলেন তখন বিক্রির নিয়তে ক্রয় করেন নি বা কেনার সময় কোন নিয়তই করেন নি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী হঠাৎ বিক্রয় করার ইচ্ছা পোষন করলেন তবে, যতক্ষন সেই জায়গা বিক্রয় না করে হাতে টাকা না আসবে ততক্ষন সেই জায়গার উপর যাকাত দেওয়া লাগবে না। হাতে টাকা পাবার পরই সেই টাকার যাকাত দিতে হবে।

এখানে একটি বিষয়, কোন সম্পদ আপনি কত দিয়ে কিনেছেন তার উপর যাকাতে হিসাব করবেন না। আপনি যাকাত হিসাব করবেন সেই সম্পদ আপনার যাকাতের দিন যদি বিক্রয় করে থাকেন তবে কি দাম পাবেন তার উপর।

যাকাত যোগ্য সম্পদের ২.৫% (আড়াই) শতাংশ হারে যাকাত আদায় করতে হয়।

যাকাতের খাত সমূহ বা কাদেরকে যাকাত দিবেন

যাকাতের মোট আট খাত রয়েছে বা ৮ ধরনের ব্যক্তিদের দিতে হয়।

১। ফকিরদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে।

২। মিসকিনদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে।

৩। যারা যাকাতের অর্থ ম্যানেজমেন্ট করবে তাদেরকে যাকাতের টাকা থেকে বেতন হিসাব বা পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে।

৪। অমুসলিমদেরকে যাকাতের টাকা দিয়ে সাহয্য করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যাকাত দেওয়া যাবে। (বর্তমানে এই খাতটি রহিত হয়ে পড়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী)।

৫। দাস মুক্তির জন্য যাকাতের টাকা দেওয়া যাবে। (বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এই খাতটিও এখন নেই)। বর্তমানে দাস প্রথা না থাকায় এই বিধানটি নেই।

৬। যারা আল্লাহ্‌-এর রাস্তায় আছে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে। এই ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যপক। যেমন:- যারা দ্বীন প্রতিষ্টার জন্য আল্লাহ্‌- এর রাস্তায় জিহাদে আছে।

৭। রূণগ্রস্থ ব্যক্তিদের যাকাত দেওয়া যাবে। তবে বিলাসিতার জন্য যারা রূণগ্রস্থ তাদের জন্য যাকাত নই। সেই সব রূণগ্রস্থদের জন্য যারা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রূণগ্রস্থদের জন্য।

৮। মুসাফির বা পথিক। যদিও বর্তমানে এখন ডিজিটালাইজের কারণে টাকা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো কোন বিষয় নই। তবে ব্যতিক্রম মুসাফির বা পথিকদের জন্য যাকাত প্রযোজ্য।

যাকাত কাদের দেওয়া যাবে না?

১। বানু হাসেম (হুজুর (সা.) এর বংশ) বংশের কোন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

২। অমুসলিমদের যাকাত দেওয়া যাবে না।

৩। কোন ধনী বা সাবলম্বি ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৪। ঔরশজাত সম্পর্কের কোন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৫। স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

উপরুক্ত বিষয়গুলির মধ্যে কোথাও কিছু ভুল হলেও হতেও পারে। কারণ আমি কোন আলেম নই। উপরুক্ত আলোচনা গুলো একজন আলেমের কাছ থেকে শুনেই আমি উল্লেক্ষ করেছি। কোন বিষয়ে সন্দেহ বা বুঝতে সমস্যা হলে আপনার নিকটস্থ যোগ্য কোন আলেম / মুফতির কাছ থেকে জেনে নেওয়া আবশ্যক। এছাড়া জমির ফসলের ওশর আদায়ের নিয়ম যাকাতের সাথে মিশ্রিত নই। জামির ফসলের আলাদাভাবে হিসাব করতে হয়।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *